গাফফার খান চৌধুরী
এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে বহাল তবিয়তে আছেন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠরা। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে কিবরিয়া গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জি এম কিবরিয়া ও তার স্ত্রী হোসনে আরা কোম্পানীর ওভারসীজ এজেন্সীর পরিচালক হিসেবে বহাল আছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোম্পানীর টাকা আত্মসাত ও পাচারের অভিযোগ রয়েছে। গোলাম কিবরিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং তার স্ত্রী ইতালী আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক। সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা এসব তথ্য জানা গেছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কোম্পানীটির লাইসেন্স দেয়। লাইসেন্স পাওয়ার পরেই শুরু হয় কোম্পানীটির নানা প্রতারণা। সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়। হাতিয়ে নেওয়া টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় কোম্পানীর কর্তা ব্যক্তিরা। টাকার বড় একটি অংশ যায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছেও। যে কারণে কোম্পানী প্রতিষ্ঠার ৩ বছরের মাথায় দেউলিয়ার পর্যায়ে চলে যায়। ঝুঁকির মুখে পড়ে বীমা গ্রাহকদের আমানত।
সুত্রটি বলছে, গ্রাহকদের অভিযোগের সুত্রধরে ঘটনার তদন্ত করা হয়। তদন্তে উঠে আসে কোম্পানিটির নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের চিত্র। যাদের মধ্যে ছিল অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প বিক্রি, বেআইনীভাবে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চহার, ক্যাশ ইন হ্যান্ডের নামে অর্থ আত্মসাত, একক প্রিমিয়ামকে মেয়াদি বীমা দেখিয়ে ব্যাপকহারে তহবিল লোপাট, সম্পদ বিনিয়োগে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতি। নানা কেলেঙ্কারির বোঝা নিয়ে কোম্পানীটিতে সিইও পদে বহাল আছেন শাহ্ জামাল হাওলাদার। অথচ তার বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
আইডিআরএ সূত্র বলছে, এসব অভিযোগে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী পদে শাহ্ জামাল হাওলাদারের পুনঃনিয়োগের প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে। কোম্পানিটির চেয়ারম্যান বরাবর এ সংক্রান্ত একটি চিঠিও পাঠান আইডিআরএ’র পরিচালক (উপ-সচিব) আহম্মদ এহসান উল হান্নান। গত বছরের ১০ জুন পাঠানো ওই চিঠিতে এসব বিষয় জানানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, শাহ জামাল হাওলাদার কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ‘চরম ঝুঁকিপূর্ণ এবং দেউলিয়া পর্যায়ে নিয়ে গেছেন’। এছাড়া তিনি আর্থিক অনিয়ম ও অপচয়ের মাধ্যমে কোম্পানি ও গ্রাহক স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করেছেন। একইসঙ্গে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। মো. শাহ জামাল হাওলাদারের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় বীমা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে। যা কোম্পানি এবং বীমা গ্রাহকদের স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
সুত্র বলছে, আইডিআরএ’র ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন শাহ জামাল হাওলাদার। রিটের শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৫ জুলাই রুলসহ আইডিআরএ’র সিদ্ধান্তে ৬ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে শাহ জামাল হাওলাদারের মুখ্য নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালনে ৬ মাসের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত চেয়ে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে চেম্বার আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত আবেদন নামঞ্জুর করে হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি করে বিষয়টি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। তবে ওই স্থগিতাদেশের ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি।
এ ব্যাপারে গৃহিত পদক্ষেপ সর্ম্পকে আইডিআরএ’র উপ-পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলায়মান জানান, বিষয়টি নিষ্পত্তিতে আইডিআরএ আইনি সব প্রস্তুতি নিয়েছে। শিগগিরই আদালতে এটি শুনানি হবে বলে আশা করছি। আইডিআরএ যেসব কারণে মুখ্য নির্বাহী পদে শাহ জামাল হাওলাদারের পুনঃনিয়োগের প্রস্তাব নামঞ্জুর করেছে আদালতে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।
এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো আইডিআরএ’র ওই চিঠিত বলা হয়, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বিগত মেয়াদে মো. শাহ্ জামাল হাওলাদারের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় বীমা আইন লঙ্ঘন করে নানা কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে। এতে করে কোম্পানি ও বীমা গ্রাহকের স্বার্থ হুমকির মুখে পড়েছে। লাইফ বীমাকারীর ব্যবস্থাপনা ব্যয় সর্বোচ্চ সীমার অতিরিক্ত ২১ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। যা অনুমোদিত সীমার ১ দশমিক ৪৮ গুণ বেশি। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বীমা পরিকল্প (সুরক্ষিত দ্বিগুণ প্রদান এক কিস্তি বীমা) বাজারজাত করা হয়েছে। লাইফ বীমাকারীর ব্যবস্থাপনা ব্যয় সর্বোচ্চ সীমা হবে ৫ শতাংশ। যার পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
কিন্তু কোম্পানির আইন অমান্য করে অনুমোদিত সীমা দেখানো হয়েছে শতকরা ৪৫ ভাগ থেকে ৯৫ ভা পর্যন্ত। যার পরিমাণ ১২ কোটি ২ লাখ টাকা। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে কোম্পানি মোট ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বেআইনীভাবে অতিরিক্ত ব্যয় করে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে। এরজন্য কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দায়ী। তিন বছরে বীমা গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্রায় ৮১ কোটি ৫২ লাখ টাকার অধিকাংশই ব্যয় করা হয়েছে। যে কারণে লাইফ ফান্ডে মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ টাকা আছে। বীমা গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধে কোম্পানির কোন বিনিয়োগ নেই। এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প বিক্রিসহ বেআইনীভাবে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চহার, ক্যাশ ইন হ্যান্ডের নামে অর্থ নয়ছয়, একক প্রিমিয়ামকে মেয়াদি বীমা দেখিয়ে ব্যাপক তহবিল লুটপাট, সম্পদ বিনিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির ১৮ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থেকে দুই দফায় ৭ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত কোম্পানীর ফান্ডে জমা হয়নি।
আইডিআরএ সুত্রে জানা গেছে, সিইও’র বেআইনী কর্মকান্ডের জন্য এনআরবি ইসলামী লাইফের পরিচালকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো অনাকাক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষিত-অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিবছর যে পরিমাণ প্রিমিয়াম আয় হয়েছে তার অধিকাংশ এসেছে অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প ‘সুরক্ষিত দ্বিগুণ প্রদান এক কিস্তি বীমা’ প্রকল্প থেকে। যার মেয়াদকাল ৬, ৮, ১০, ১২, ও ১৫ বছর। যদিও প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের কাছ থেকে ৬ বছর মেয়াদে একক প্রিমিয়াম নিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানির প্রতিষ্ঠা থেকে একক প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ৩০ লাখ টাকা। পরের বছর ২০২২ সালে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে সংগ্রহ করে প্রায় ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। মোট সংগ্রহ করা হয় প্রায় ২৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে জীবন বীমা ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হারে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয় করার কথা ছিল। কিন্তু আইডিআরএ’র নির্দেশনা অমান্য করে সিইও শাহ জামাল হাওলাদারের নির্দেশনায় কৌশলে ডাটা জালিয়াতির (একক বীমা প্রিমিয়ামকে মেয়াদি বীমায় রূপান্তর র) মাধ্যমে কখনো ৪৫ শতাংশ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে। ব্যয় দেখানো টাকার প্রায় পুরোটাই আত্মসাৎ করা হয়েছে কোম্পানী চেয়ারম্যান, তার স্ত্রীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট।
সুত্র বলছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রথম বছর প্রিমিয়াম, নবায়ন ও গ্রুপ বীমা থেকে সংগ্রহ কওে ৮১ কোটি টাকা। এরমধ্যে ২০২১ সালে আয় করে ৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ২০২২ সালে ২৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা ও ২০২৩ সালে ৪৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তিন বছরে প্রিমিয়াম, নবায়ন ও গ্রুপ বীমা থেকে আয়ের ৮১ কোটি টাকার মধ্যে অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প ‘সুরক্ষিত দ্বিগুণ প্রদান এক কিস্তি বীমা’ থেকে এককালীন প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। সুত্র বলছে, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ৮১ কোটি টাকা ব্যবসা করলেও প্রতিষ্ঠানটি লাইফ ফান্ড সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। উল্টো কোম্পানি একক কিস্তি বীমা পরিকল্প থেকে এককালীন হারে যে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে তার পুরোটাই ডাটা জালিয়াতির মাধ্যমে ঘাটতি দেখিয়েছে। এতে করে বর্তমানে কোম্পানিটিতে চরম তারল্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।