Jaijaidin

লোকজ মেলার বড় বাঁধা যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ উপদেষ্টা ফারুকী

Shah Alam Soulav
5 Min Read

সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

বাংলাদেশ লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের প্রধান বাঁধা এখানকার এপ্রোচ রোড খুবই সরু। এ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা গাড়ি নিয়ে নির্বিঘ্নে আসতে পারে এবং এ মেলার প্রচার আরো ব্যাপকভাবে প্রসার করার আহবান জানান তিনি। আজ বিকেল ৪টায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

প্রতিবছরের মতো এবারও উৎসবের আয়োজন করেছে লোকশিল্প যাদুঘর। ১৮ জানুয়ারি রবিবার বিকেলে মাসব্যাপী মেলা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলম এর সভাপতিত্বে সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মফিদুর রহমান, বিশেষ অতিথি ছিলেন, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা, জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার, ঢাকা রিজিয়নের ট্যুরিষ্ট পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক, সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা রহমান প্রমূখ। মেলা চলবে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

বাংলার লোকশিল্পের প্রতি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনুরাগ ছিল প্রগাঢ়। তাঁর চর্চা আর ধ্যান-জ্ঞানে ছিল লোকজ সংস্কৃতি। বাঙালির মৌলিক চর্চাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ফোকফর্ম। অভিন্ন চাওয়া থেকে ১৯৭৫ সালে সোনারগাঁয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। সেই চেতনার জায়গা থেকে আয়োজকরা তৃণমূলের লোকশিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সোনারগাঁয় নিয়ে আসেন। একেবারে তৃণমূলের জাতশিল্পীরা অংশ নেন মেলায়। বংশ পরম্পরায় যারা লোক কারু ও হস্তশিল্পের কাজ করেন, যারা আদি ফর্মগুলো অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছেন তারাই এখানে প্রধান আকর্ষণ। মেলায় স্টল সাজিয়ে বসেছেন তারা। সবার চোখের সামনে কাজ করছেন। মেলা ঘুরে এসব কাজ যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমনি সংগ্রহ করা যাচ্ছে লোকশিল্পের বিলুপ্ত প্রায় নিদর্শন।

মাসব্যাপী লোকজ মেলার ময়ূরপঙ্খি স্টেজে চলবে জারি-সারি, পুঁথি পাঠসহ লোকগীতি পরিবেশনা।

একটি স্টলে রয়েছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি। স্টলের স্বত্বাধিকারী সুশান্ত কুমার পাল জানান, কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ৩৫টি সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে স্টলে বসেই শখের হাঁড়ি অলঙ্করণ করছিলেন।

তাঁদের একজন সঞ্জয় বলেন, ‘দুই ভাই বাবার কাছ থেকেই কাজ শিখেছি। খুব ভালো লাগে।’ অন্য একটি স্টল ঢাকার রায়েরবাগের বিপদ ধরি পালের। তিনি চ্যানেল আই পুরস্কারপ্রাপ্ত শখের হাঁড়ির শিল্পী। দুটি স্টলে আছে কাঠের পুতুল আর চাকা লাগানো ঘোড়া।

সোনারগাঁয়ের ভট্টপুর গ্রামের বীরেন্দ্র সূত্রধর ও আশুতোষ সূত্রধর এই শিল্প ধরে রেখেছেন। আশুতোষের স্ত্রী সন্ধ্যা রানী আপন মনে পাখা সেলাইয়ের কাজ করেন। কিশোরগঞ্জের সৈয়ালপাড়া গ্রামের আরতি রানী নরম মাটি টিপে অসংখ্য ছোট ছোট ফিগার গড়েছেন। নিখুঁত অবয়ব না হলেও রূপটা এত আদি ও অকৃত্রিম যে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তিনি কাজ শিখেছেন মা রেণু রানী পালের কাছে।

সোনারগাঁয়ের দারুশিল্পী হাজি আউয়াল প্রধানের তৈরি শিল্প বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। সুন্দর, নিখুঁত নানা তৈজসপত্র তৈরি করে সম্মাননা পেয়েছেন অনেক। তিনি এই কারুকাজের ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে।

শিল্পী পরেশ চন্দ্র বেত দিয়ে তৈরি করেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসসহ ময়ূরপঙ্খি নৌকা, ট্রাক, মোড়া ও নানারকম খেলনা। বরিশালের শংকর মালাকারের ছেলে নিখিল মালাকার শোলার ফুল ও টোপর তৈরি করেন। তাঁর পরিবারের সবাই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

ধাতব শিল্পের চমৎকার একটি স্টল রয়েছে মেলায়। বাকুরার ঘোড়া, মিসরের মূর্তি, হিন্দু মিথলজির নানা চরিত্র গড়েছেন তামা-পিতল-কাঁসা শিল্পী মানিক সরকার।

নানা নকশার শীতলপাটি নিয়ে এসেছেন হরেন্দ্র কুমার দাস। মৌলভীবাজারের ধূলিজুরা গ্রামের এই বেতশিল্পী জানান, ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি এখন তারা সমকালীন চাহিদার কথাও মাথায় রাখছেন। এ কারণে টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট ইত্যাদিও তৈরি করছেন।

মেলায় সুচি শিল্পের নকশিকাঁথা নিয়ে এসেছেন সোনারগাঁয়ের হোসনেয়ারা বেগম। তাঁর সুঁইয়ের প্রতিটি ফোঁড় যেন কথা বলে। সৌখিনতার গল্প বুনে চলেন। আধুনিক নকশায় প্রাচীন সেলাইয়ের নতুন ফর্ম। এই সুচিশিল্পী বলেন, ‘আমি সুঁই-সুতা দিয়ে আমার স্বপ্ন বুনে যেতে চাই আজীবন।’ মেলায় আছে রংপুরের শতরঞ্জিও।

কথা হয় কবি শাহেদ কায়েসের সঙ্গে। আরও গভীরে গিয়ে তিনি বলেন, আঞ্চলিকতাই হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং মধুর বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর কোনো দেশে এত আঞ্চলিক ভাষা নেই। ঠিক তেমনি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিল্পও নেই। যে অঞ্চলে যে ধরনের উপাদান বেশি পাওয়া যায় তা-ই কাজে লাগিয়ে শিল্পকর্ম করেন লোকশিল্পীরা। এ কারণে দেখা যায় সিলেটে শীতল পাটি, যশোরে নক্সিকাঁথা, রংপুরে বাঁশ বেত শিল্পের নিদর্শন বেশি হয়। বংশপরম্পরায় কাজ করেন লোকশিল্পীরা। লোকশিল্প লোকশিল্পী নিজে বানান। স্বাধীন সৌন্দর্যবোধ থেকে কাজ করেন তারা। এক ধরনের আবেগের অবাদ প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। এখানেই ব্যতিক্রম হয়নি।

মেলা প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলম বলেন, লোকায়ত জীবন ও শিল্পের কাছে গিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই লোকজ মেলার আয়োজন।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *