যাযাদিপ্র ডেস্ক
শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দীর্ঘদিন ধরে বেতনবিহীনভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং মানবেতর জীবন যাপনের চিত্র তুলে ধরতে এবং বেতনভাতা নিয়মিতকরণে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ সংকটের দ্রুত সমাধানে সরকার, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অধীনে স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর (HPNSP) কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত “হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (HSM)” শীর্ষক অপারেশন প্ল্যানের আওতায় সেকেন্ডারী ও টারশিয়ারী লেভেল হাসপাতালসমূহে “শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন” একটি চলমান প্রকল্প, যা ২০০৮ সাল হতে পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০০৯ সালের আগষ্ট মাসে সর্বপ্রথম ৫টি টারশিয়ারী লেভেল হাসপাতালে এই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে সেপ্টেম্বর-২০১০ এবং ফেব্রুয়ারী-১৪ সালে বিভাগীয় পর্যায়সহ আরো ১০টি হাসপাতালে “শিশু বিকাশ কেন্দ্র” স্থাপিত হয়। ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে মার্চ-২০২১ সালে নতুন আরো ২০টি কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। এ প্রকল্পের অধীনে ২৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ১১টি জেলা সদর হাসপাতালে “শিশু বিকাশ কেন্দ্র” স্থাপন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল কলেজ এবং সদর হাসপাতালগুলোতে অবস্থিত এ সকল কেন্দ্রে বর্তমানে ১৭২ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিরলসভাবে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেবাপ্রদান করে যাচ্ছেন। প্রতিটি কেন্দ্রে শিশু স্বাস্থ্য চিকিৎসক, শিশু মনোবিজ্ঞানী, এবং ডেভেলপমেন্টাল থেরাপিস্টের সমন্বয়ে একটি করে বিশেষজ্ঞ দল ০-১৬ বছর বয়সী শিশুদের বিকাশগত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকেন। এতে করে বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত, পিছিয়ে পড়া, এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা সরকার নির্ধারিত নামমাত্র ১০ টাকা টিকিট মূল্যে নিজ জেলায় বসে স্বল্পসময়ে, একই স্থানে, বহুমাত্রিক, এবং সর্বাধুনিক চিকিৎসা সেবা নিতে পারছে। এসব ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে নিয়মিত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া গেলে শিশুদের প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ, সমস্যা হ্রাস, এবং কাজকর্ম ও দৈনন্দিন জীবনযাপনের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা তৈরি করা সম্ভব, যার সুফল তারা আজীবন পেয়ে থাকে। তাই, পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি একটি মহৎ মানবিক দায়িত্ব হিসেবেও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিয়মিত এ সেবাগুলো প্রদান করে যাচ্ছেন। ফলস্বরূপ, শিশু বিকাশ সহযোগী হিসেবে এ কেন্দ্রগুলো উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং এসডিজির সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত, বিকাশ বিলম্বিত, ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জীবনমান উন্নয়ন, তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা এবং সমাজে তাদের সম্মানজনক স্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ কেন্দ্রগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবদান অপরিসীম।
সংবাদ সম্মেলনে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সম্পর্কে তারা জানান –
১. ৩৫টি সেকেন্ডারী ও টারশিয়ারী স্তরের হাসপাতাসমূহে “শিশু বিকাশ কেন্দ্র” স্থাপনের মাধ্যমে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে বসবাসকারী নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার/ডিজিস সম্বলিত বিকাশ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও প্রতিবন্ধি শিশুরা নিবিচ্ছিন্নভাবে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা নামমাত্র পরিষেবামূল্যে গ্রহণ করতে পারছে। যা সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচন ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
২. বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা গ্রহণের মাধ্যমে এসকল শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে দৈনন্দিন কর্মকান্ডে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে করতে পারছে। যার ফলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিবন্ধি শিশুদের বিশেষায়িত সেবা প্রদানের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, মানবাধিকার রক্ষা ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে।
৪. বিকাশ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও প্রতিবন্ধি শিশুদের বিশেষায়িত সেবা প্রদানের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
শিশু বিকাশ কেন্দ্র সমূহের বর্তমান চিত্র তুলে ধরে তারা বলেন, শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসকগণ বিগত ১৫ বছরের ন্যায় প্রতিদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, যেন বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রন্ত শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ পেতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ বিগত ৮ মাস ধরে বেতন ছাড়াই কাজ করছেন।
বেতনবিহীন অবস্থার প্রভাব সম্পর্কে বলেন, বেতনবিহীন অবস্থায় দীর্ঘদিন কাজ করা কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সহজ নয়। এই কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ তাদের পরিবারের ভরণপোষণ, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বেতনের ওপর নির্ভরশীল। বেতন না পাওয়ার কারণে তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে একজন অফিস ক্লিনার আর্থিক দুঃশ্চিন্তায় স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকেই ঋণের বোঝা বহন করছেন, অনেকে পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত জীবনেই প্রভাব ফেলছে না, এটি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রমেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বেতন না পাওয়ার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল হ্রাস পাচ্ছে, যা তাদের কাজের গুণগত মানকে প্রভাবিত করছে। এটি বিকাশ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবার মানও হ্রাস করতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এসময় বৈষম্য ও অবহেলার চিত্র তুলে ধরে তারা বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বিগত ১৫ বছর ধরে সমাজের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে আসছেন। অথচ তাদের সাথে যে বৈষম্য করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা তাদের ন্যায্য বেতন ও ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা তাদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। তারা বিকাশ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য কাজ করছেন। তাদের এই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পাওনা ন্যায্য বেতন ও ভাতা প্রদান করা এখন সময়ের দাবি। তাদের সাথে যে বৈষম্য করা হচ্ছে, তা অবিলম্বে দূর করা উচিত। উল্লেখ্য যে, শিশু বিকাশ কেন্দ্রের ৫০% এর উপরে নারী সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তারা স্ববৈতনিক মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকেও প্রতিষ্ঠাকাল হতে বঞ্চিত। যেখানে এসকল নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ শিশুদের বিকাশে নিরলসভাবে কাজ করছেন, সেখানে তাদের স্পর্শকাতর সময়ে বৈষম্যের শিকার হয়ে এসেছেন।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সম্পর্কে তারা বলেন, এই সংকটের সমাধান সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে। শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ন্যায্য দাবি পূরণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তাদের পাওনা বেতন ও ভাতা অবিলম্বে পরিশোধ সহ নিয়মিত বেতন ভাতা চালু করা এবং তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন অপরিহার্য। আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাই, তারা যেন এই ইস্যুটিকে গুরুত্বের সাথে নেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সংকটের সমাধান করেন। শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা সমাজের জন্য যে অবদান রাখছেন, তার স্বীকৃতি হিসেবে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
এ বিষয়ে সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের ভূমিকা আছে জানিয়ে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেন, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের ভূমিকা এই সংকট সমাধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করি, সাংবাদিকরা এই ইস্যুটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করবেন এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। সুশীল সমাজও এই ইস্যুতে তাদের কণ্ঠস্বর উত্থাপন করবেন এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের পাশে দাঁড়াবেন।
তাদের তুলে ধরা দাবিগুলো হচ্ছে –
১. শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিগত মাসের প্রাপ্য বকেয়া বেতন ও ভাতা অবিলম্বে পরিশোধ করা হোক।
২. ভবিষ্যতে যেন কোনো বিলম্ব না হয়, সে জন্য বেতন ও ভাতা প্রদানের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করা হোক।
৩. শিশু বিকাশ কেন্দ্রসমূহকে রেভিনিউ বাজেটের অন্তর্ভুক্তি বা সরকারি বিশেষ সেবাদানকারি গুরুত্বপূর্ণ জরুরি সেবা হিসাবে চালুর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।
৪. শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হোক।
৫. বিকাশ জনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবার মান উন্নয়নের জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন করা হোক।
তারা বলেন, শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ সমাজের জন্য যে অবদান রাখছেন, তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। তাদের ন্যায্য দাবি পূরণ করা এবং তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। আমরা আশা করি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই সংকটের সমাধান করবেন এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাশে দাঁড়াবেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ যেন এই ইস্যুটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেন এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন যাপন থেকে মুক্তি ও ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য তারা সকলের সমর্থন ও সহযোগিতাও কামনা করেন।