গাফফার খান চৌধুরী
সক্রিয় কুইক হাইজ্যাকার বা দ্রুত গতির ছিনতাইকারী চক্রগুলো। চোখের পলকে তারা গুলি করে টাকা ছিনিয়ে নেয়। ঢাকায় এমন অন্তত ২৫টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। গ্রুপের সদস্য শতাধিক। তারা মোটরসাইকেলযোগে ছিনতাই করে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ বলছে, ঈদ উপলক্ষে দ্রুত গতির ছিনতাইকারীরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। যার প্রমাণ মিলেছে মঙ্গলবার সকালে। এদিন সকাল ১০টার দিকে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে দ্রুত গতির ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে আব্দুল বাতেন সড়কে প্রকাশ্যে ‘মাহমূদ মানি এক্সচেঞ্জ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মাহমুদুল ইসলামকে (৫৫) গুলি চালিয়ে আহত করে তার সঙ্গে থাকা ২২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। মাহমুদ ঢাকার শেরেবাংলানগর থানাধীন শহীদ সোহরাওয়াদী মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আহত ব্যবসায়ী জানান, তিনি মিরপুর ৪ নম্বর লেনের ৬ নম্বর সেকশনের বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর-১০ নম্বর তার অফিসে যাচ্ছিলেন। স্টেডিয়ামের ওখানে গেলে ঘটনাটি ঘটে। ২টি মোটরসাইকেলে আসা ৬ জন ছিনতাইকারী তার গতিরোধ করে। টাকা দিতে দেরি হওয়ায় তার পেট লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দেয় ছিনতাইকারীরা। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তারা টাকা নিয়ে দ্রুত মোটরসাইকেলেই পালিয়ে যায়। তার বাড়ি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার কারতা গ্রামে।
মিরপুর মডেল থানার ওসি মো. সাজ্জাদ রুম্মন জানান, ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা চলছে। অপরাধীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি ছিনিয়ে নেওয়া টাকা উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, দূর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের ঘটনার পর পরই সেনাবাহিনী ও পুলিশর অতিরিক্ত সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। তারা পুরো এলাকায় তল্লাশী করেন। একই সঙ্গে স্টেডিয়াম ও সুইমিং পুলিশের বিপরীত পার্শ্বে মিরপুর-১ নম্বরের দিকে যাওয়ার রাস্তায় যৌথ চেকপোষ্ট বসায়। যেখানে সব ধরনের মোটরসাইকেলে তল্লাশী চালানো হয়। দুই জন সেনা কর্মকর্তার সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে চেকপোষ্ট পরিচালিত হয়। ওই পথ দিয়ে যাওয়া সকল মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের দেহ থেকে শুরু করে সবকিছুই তল্লাশী করা হয়েছে। যদিও মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করার খবর পাওয়া যায়নি। এমন উদ্ধার হয়নি ছিনতাই হওয়া টাকা। এ ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের আসামী করে মামলা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মিরপুরের ঘটনাটি এমন কোন গ্রুপের কাজ। তবে তারা কোথায় থেকে এসেছিল তা জানা সম্ভব হয়নি। তাদের শনাক্ত করতে ঘটনাস্থলে ও আশপাশে ব্যবহৃত মোবাইলের সন্দেহজনক যোগাযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঢাকায় প্রতি ২টি থানায় অন্তত একটি করে এমন দ্রুত গতির ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয় আছে। সে হিসেবে ছিনতাইকারী গ্রুপের সংখ্যা ২৫টি। প্রতিটি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা ৪ থেকে ৬ জন। ছিনতাই করতে তারা সাধারণত ২টি বা কোন কোন ক্ষেত্রে ৩টি মোটরসাইকেল ব্যবহার করে।
গোয়েন্দারা বলছেন, এমন ছিনতাইকারীদের পছন্দ জাপানী টু স্ট্রোক মোটরসাইকেল। কারণ এসব মোটরসাইকেল রাস্তায় নষ্ট হওয়ার ভয় কম। এছাড়া এসব মোটরসাইকেল সাধারণত চোরাইপথে আনার কোন সুযোগ নেই। মোটরসাইকেলগুলো বৈধ। বৈধ মোটরসাইকেল দিয়ে অবৈধ কাজ হওয়ার বিষয়টি খানিকটা অস্বাভাবিক। এসব কারণে পুলিশ এ ধরণের মোটরসাইকেল সাধারণত চেক করে না। কারণ যারা এসব মোটরসাইকেল চালান, তাদের সবারই বৈধ লাইসেন্স ও মোটরসাইকেলের বৈধ কাগজপত্র আছে বলে পুলিশ সদস্যদের ধারণা করে থাকেন। যদিও সম্প্রতি গ্রুপগুলো অন্যান্য দেশের তৈরি দ্রুত গতির মোটরসাইকেলও ছিনতাইয়ে ব্যবহার করছে। চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করা কঠিন। কারণ এক থানার ছিনতাইকারীরা দুরবর্তী কোন থানায় গিয়ে ছিনতাই করে। অপরাশেন শেষে গ্রুপের সদস্যরা ঢাকা ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যায়। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও ছিনতাই বা খুন বা অপহরণ বা ডাকাতির মত অপরাধ করতে অপরাধীদের ঢাকায় আনে চক্রগুলো। গোয়েন্দা সুত্রগুলো বলছে, ঢাকায় নানা ইস্যুতে আন্দোলন সচল থাকার সুযোগ নিচ্ছে এসব ছিনতাইকারীরা। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি ব্যস্ততার পুরোপুরি সুযোগ নিচ্ছে। এসব ছিনতাইকারী গ্রুপগুলো ছোট আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। ছিনতাইয়ে বাধা দিলে তার কাউকে গুলি বা হত্যা করতেও দ্বিধা করে না।
গ্রুপগুলোর প্রধান টার্গেট ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কেও টাকা উত্তোলনকারী ও জমাদানকারীরা। গ্রুপগুলো তিন স্তরে কাজ করে। প্রথম স্তরের ২ থেকে ৩ সদস্য ব্যাংকের ভেতরে কেতাদূরস্ত অবস্থায় অবস্থান করে। তাদের গায়ে থাকে দামি পোশাক। হাতে একাধিক দামি মোবাইল। ভাবখানা এমন যেন ব্যাংকের বড় মাপের কাস্টমার। অথবা কোন পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছে। আসলে তারা ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের দিকে সর্বক্ষণিক নজর রাখে। ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কেও টাকা উত্তোলন করা মাত্রই খবর পৌঁছে যায় নীচে অবস্থান নিয়ে থাকা দ্বিতীয় স্তরের কাছে। তারা ব্যাংকের নিচে ২/৩টি মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মূলত এই গ্রুপটিই অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করে। এ গ্রুপটিকে সহায়তা করার জন্য আরেকটি গ্রুপ তাদের অনুসরণ করে। প্রথম গ্রুপ ছিনতাইয়ে ব্যর্থ হলে অনুসরণকারী দ্বিতীয় গ্রুপটি সুবিধাজনক জায়গায় অস্ত্রের মুখে বা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে বা কোন কোন সময় গুলি চালিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে আহত বা হত্যা করে টাকা ছিনিয়ে নেয়।
সুত্র বলছে, অনেক সময় ব্যাংক কর্মকর্তারাও দ্রুত গতির ছিনতাইকারী গ্রুপগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকে। কারণ ব্যাংকের অনেক গ্রাহকের সঙ্গেই ব্যাংক এক বা একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ থাকে। অনেক গ্রাহক মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার আগেই পরিচিত কোন ব্যাংক কর্মকর্তা বা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মূলত সেখান থেকেই তথ্য পাচার হয়ে চলে যায় ছিনতাইকারীদের কাছে। ব্যাংক কর্মকর্তা গ্রাহকের কাছে কখন আসছেন বা আসবেন তা জানতে চায়। গ্রাহক পরিচয়ের সুবাদে তা বলে দেন। সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগায় ব্যাংক কর্মকর্তাদেও সঙ্গে যুক্ত থাকা ছিনতাইকারী গ্রুপগুলো। এমন তথ্য পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি গ্রাহক নুন্যতম আন্দাজ করতেই পারেন না। ছিনিয়ে নেওয়া টাকার একটি বড় অংশ পেয়ে থাকে ওইসব অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তা বা কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলছেন, এমন দূর্ঘটনা এড়াতে সব সময়ই পুলিশের তরফ থেকে নগদ টাকা স্থানান্তর বা লেনদেন যথাসম্ভব কম করতে মানুষকে উৎসাহিত করা হয়। এমনকি ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও গ্রাহকদের নগদ টাকা বহনে পুলিশের সহায়তা নেওয়ার কথা বলা হয়। যাতে করে অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে। তিনি বলেন, গ্রাহকদের উচিত টাকা উত্তোলন বা জমা দেওয়ার বিষয়টি ব্যাংক কর্মকর্তা বা ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কাউকে আগাম না জানানো। এমনকি টাকার বিষয়টি গোপন রাখতে অন্য কারো সঙ্গে আগাম আলোচনা না করাই নিরাপদ। কারণ এতে করে ঝুঁকি থাকে। সামনে যেহেতু ঈদ তাই টাকা লেনদেনের বিষয়ে সবাইকে আরো সর্তক হওয়া উচিত।
অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে ঢাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নজরদারি ও চেকপোষ্ট বসিয়ে তল্লাশী। পাশাপাশি বেশী টাকা স্থানান্তরে পুলিশের মানি এস্কর্ট টিমের সহায়তা নেওয়ার কথা বলেন তিনি। তবে এ টিমের সহায়তা নিতে টাকার মালিককে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে।