নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারেন না। অথচ কানাডার নাগরিক হওয়ার পরেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১ আসন থেকে অংশ নিয়ে এমপি হয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বা মন্ত্রিত্ব লাভের সুযোগ নেই। তথ্য গোপন করে যদি এ কাজ হয়ে থাকে, তাহলে আইন ও সংবিধান পরিপন্থী কাজ হয়েছে। মানে তিনি রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
দুদকের অনুসন্ধান টিম জানতে পেরেছে কানাডার নাগরিকত্ব রয়েছে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের। তার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চিঠিতে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে তা দুদককে অবহিত করতে বলা হয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য নাসিম বড় অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন—এমন তথ্য দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। কানাডায় বাড়ি, ব্যবসাসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর (নাসিম)। তাঁর মেয়ে কানাডায় থাকেন।
দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান করছে দুদক। তার দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। নাগরিকত্বের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। সেজন্য তাদেরকে চিঠি পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে গনমাধ্যমকে বলেন, খুন-গুম ও ভিন্নমতকে দমনের পাশাপাশি দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন দিয়ে মন্ত্রী-এমপি করার দায়ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিতে হবে। পাশাপাশি বিগত নির্বাচন কমিশনগুলোকেও এ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি বলেন, পুরো নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। অবশ্যই এর বিচার হতে হবে।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেনবলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। যাঁরা টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে যাঁরা দেশে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের মর্যাদা-সুবিধা ভোগ করেছেন, তাঁরা আসলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁদের শপথ গ্রহণই ছিল অবৈধ। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হওয়ার বিষয়টি এখন আর অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়। এর কারণ দেশে যেভাবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারহীনতার বিকাশ হয়েছে, তাতে এগুলো স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তথ্য গোপন ও প্রতারণা করা ওই সব প্রভাবশালীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এখন জরুরি।
ফেনী-১ আসনের সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। দুদকে দেওয়া আবেদনপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন, সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম ছিলেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার। নাসিমের বাড়ি সীমান্তবর্তী উপজেলা পরশুরাম পৌরসভার গুথুমা গ্রামে। যার তিন পাশে সীমান্ত। তার নেতৃত্বে এই সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরা থেকে অবৈধভাবে মাদক, ফেনসিডিল, গরু ও শাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক আসে বাংলাদেশে। দেশ থেকে পাচার হয় স্বর্ণ। ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার পদবি ব্যবহার করে প্রশাসনে বদলি, পদায়ন থেকে শুরু করে বিনা টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দেওয়া, বিদ্যুৎ কোম্পানির লাইসেন্স দেওয়ার কাজ শুরু করেন নাসিম। ফেনীকে বানিয়েছিলেন অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। বালুমহাল, টেন্ডার বাণিজ্য, সালিশি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ও সীমান্ত থেকে চোরাকারবার চলতো তার নির্দেশে। তাকে ২০ শতাংশ কমিশন না দিলে কোনও টেন্ডারই পেতেন না ব্যবসায়ীরা। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই বুঝে নিতেন কমিশন। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির কারণে অনেকে ধরা পড়লেও সব সময় অন্তরালে থেকে গেছেন নাসিম। গত সাড়ে ১৫ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এই খাত থেকে বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন।