Jaijaidin

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের থিসিসের ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগে তোলপাড়

Shah Alam Soulav
6 Min Read

গাফফার খান চৌধুরী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে আওয়ামী পন্থী শিক্ষকচক্রের দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ফলাফল বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওই বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. সাজিদ ইকবালের এমন অভিযোগের ঘটনায় রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে ১০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ মার্চ ফলাফল বিপর্যয়ের পেছনে আওয়ামী পন্থী শিক্ষকদের দুর্নীতি ও প্রতিহিংসার অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য বরাবর আবেদন দাখিল করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মো. সাজিদ ইকবাল। ঘটনাটি প্রথমে গোপন থাকলেও পরে প্রকাশ পেয়ে যায়। এমন ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে রীতিমত তোলপাড় চলছে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর দাবি, তার থিসিস সুপারভাইজারের ফিডব্যাক ও মার্কিং ভাল ছিল। এমনকি ২টি থিসিস সেমিনারে প্রেজেন্টেশনও হয়েছে। এ সময় কেউ কোন নেগেটিভ কমেন্ট করেননি। সবাই থিসিসের প্রশংসা করেছেন। ১ম থেকে ৭ম সেমিস্টার পর্যন্ত সিজিপিএ ৩ দশমিক ৮১ থাকলেও কারসাজি করে ৮ম সেমিস্টারে ৬ ক্রেডিটের থিসিসে বি+(৩.২৫) দিয়ে তার ফলাফলে ধ্বস নামানো হয়েছে। ৮ম সেমিস্টারের ফলাফল ৩ দশমিক ৫৫ করে তার চূড়ান্ত সিজিপিএ ৩ দশমিক ৭৮ করা হয়েছে। যা স্পষ্টই পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেয়।

ভ’ক্তভোগী শিক্ষার্থীর দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক জুলাই অভ্যুত্থানে জড়িতদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনিও অভ্যুত্থানে জড়িত ছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই শিক্ষকের এমন মন্তব্য তাদের মনে বাজে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। গত বছরের ২ আগস্ট এর প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি একটা পোস্ট দেন। পোস্টটি শিক্ষকদের নজরে পড়ে। তারই জের ধরে বিভাগের আওয়ামী পন্থী শিক্ষকরা চক্রান্ত করে তার ফাইনাল সেমিস্টারের রেজাল্টে হেরফের করেছেন। কয়েকজন শিক্ষকের মাধ্যমে তিনি বিষয়টি আগেই জানতে পেরেছেন। পরবর্তীতে তিনি গ্রেডশিট তুলে নিশ্চিত হন।

শুধু তাই নয়, পরীক্ষা কমিটিতে থাকা অন্য শিক্ষকদের না জানিয়ে তার থিসিস থার্ড এক্সামিনারের কাছে পাঠানো হয়েছে। যাতে করে তাকে কম নম্বর দেওয়া হয়। আওয়ামী পন্থী শিক্ষকরা প্রভাব খাটিয়ে তাঁদের অনুগত শিক্ষার্থীদের সন্তোষজনক গ্রেডসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অতীতেও একাধিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন বৈষম্য করা হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আরও দাবি করেন, বিভাগের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক অধ্যাপক শফিকুর রহমানের অপসারণের দাবিতে বিভাগীয় সভাপতির কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে ওই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফসান হক আলোচনার নামে শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযোগ করলে অভিযোগকারীদের একাডেমিক ফলাফলের ক্ষতি হতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফসানা হক যায়যায়দিনকে বলেন, আমি নীতি নৈতিকতা মেনে শিক্ষকতা করি। শফিক স্যারের অপসারণের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সময় ছাত্ররা যাতে মব জাস্টিজের মত ঘটনা না ঘটায় এজন্য আমি শিক্ষার্থীদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি। শিক্ষার্থীরা সন্তানের মত, তাই তাদের হুমকি ধমকি বা ভয়ভীতি দেখানোর প্রশ্নই আসে না। এসবই মনগড়া অভিযোগ। পুরো বিষয়টি তদন্তে পরিষ্কার হবে।
অভিযোগকারী শিক্ষার্থীর থিসিসের সুপারভাইজার সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা জানান, সাজিদ ইকবাল তার সুপারভিশনে থিসিস করেছে। ২টি সেমিনারও করেছে। তার কাজ সন্তোষজনক। আশা করা যাচ্ছিল তার ভালো গ্রেড আসবে। সাজিদের থিসিসের ফার্স্ট এক্সামিনার হিসেবে তিনি যে নম্বর দিয়েছেন, দ্বিতীয় এক্সামিনার যদিও তার কাছাকাছি নম্বর দিতেন, তাহলেও গড়ে ভালো গ্রেড আসতো। গ্রেডশিটে যে নম্বর এসেছে এবং যেভাবে মুল্যায়ন করা হয়েছে গ্রেডশিটে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।

অভিযোগের বিষয়ে পরীক্ষা কমিটির প্রধান অধ্যাপক গোলাম মঈনুদ্দিন জানান, পরীক্ষা কমিটির তিন জনের মধ্যে একজন প্রথম সেমিস্টারের শেষ দিকে দেশের বাইরে চলে যান। পরীক্ষা কমিটিতে তিন জনই থাকতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। পরীক্ষা কমিটির সদস্য দুইজনও হতে পারে। শিক্ষকরা যে বিষয় পড়ায় শুধু সেই বিষয়েই যে শিক্ষকদের গবেষণার এরিয়া, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ওই দুজন শিক্ষকের ওই বিষয়ে অনেক কাজ রয়েছে। তার ভিত্তিতে তাদেরকে পরীক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে।

সুত্র বলছে, আওয়ামী পন্থি শিক্ষকদের পরামর্শে সহযোগী অধ্যাপক লুৎফুর রহমানসহ কয়েকজন শিক্ষক বিভাগের ৪৮ থেকে ৫৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে অভিযোগকারী সাজিদ ইকবালের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধের ভুল দেখিয়ে বলেন, ভালো থিসিস করতে হলে এরকম ভুল করা যাবে না। আর এ থিসিসটি দুর্বল থিসিস হয়েছে বলে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরেন। শিক্ষার্থীদের হাতিয়ার হিসেবে আন্দোলনে নামানো হয়েছে। যা পরিকল্পিত। এছাড়া ড. আফসানা হক এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষকতা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছার কথা জানিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজ করেছেন।

ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশামন গত ১৬ চার সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সভাপতি করা হয়েছে গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মাহবুব কবিরকে। সদস্য সচিব হচ্ছেন, ডেপুটি রেজিস্ট্রার (টিচিং) ড. বি এম কামরুজ্জামানকে। কমিটির দুই সদস্য হচ্ছেন ভ’গোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ নজরুল ইসলাম ও ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. সোহেল রানা। বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ড. এ বি এম আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে কমিটিকে সুপারিশসহ ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

বিষয়টি সর্ম্পকে যোগাযোগ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক ড. শফিক যায়যায়দিনকে বলেন, ২৫ বছরের শিক্ষকতার ইতিহাসে কোন ছাত্রের আদর্শ দেখে নম্বর বা বাড়তি সুবিধা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। একজন ছাত্র আগাম কিভাবে তার ফলাফল সর্ম্পকে জানতে পারে, সেটিও আমার বোধগম্য না। কারণ এটি অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়। অভিযোগের তদন্ত চলছে। নিশ্চয়ই তদন্তে পুরো বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।

এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান যায়যায়দিনকে বলেন, অভিযোগ মোতাবেক পুরো ঘটনার সঙ্গে অনেকেই জড়িত। এজন্য জড়িতদের কথা বলতে হবে। বলতে গেলে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কাজ পুরোপুুরি শুরু হয়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোাগ করা হচ্ছে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তদন্ত শেষ হবে।

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *