সুমিত রেহমান
বিশ্ব সুখ দিবস উপলক্ষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এই বছরের ‘সুখ প্রতিবেদন’ প্রকাশ করেছে, যেখানে উঠে এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ কতটা সুখী। সাধারণত এ তালিকায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোই শীর্ষ দশে থাকে এবং টানা আট বছর ধরে ফিনল্যান্ড প্রথম স্থানে রয়েছে।
নিচে শীর্ষ দশ দেশের তালিকা দেয়া হলো :
তালিকায় অনুসারে ফিনল্যান্ডের মানুষ গত বছরের তুলনায় আরো বেশি সুখী হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তাদের এত সুখের কারণ কী? দেশটি বছরের ছয় মাস প্রতিদিন প্রায় ২০ ঘণ্টা অন্ধকার থাকে, শীতকালে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে, কর এবং দ্রব্যমূল্য অত্যন্ত বেশি তারপরও তারা এত সুখী কেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ও তাদের পরিচালিত জরিপগুলোর মধ্যে।
একসঙ্গে খাওয়া সুখের একটি বড় কারণ। আমেরিকায় প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ একা খায়, যা হয়তো তাদের সুখের র্যাংকিংকে ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নামিয়ে এনেছে ২৪তম। বৃটেনের ঠিক নিচে ২৩তম স্থানে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একটি পরিবারে কতজন সদস্য থাকে। চারজন বা তার বেশি সদস্য থাকলে দেশের মানুষের সুখের মাত্রা অনেক বেড়ে যায় এজন্য মেক্সিকো ও কোস্টা রিকা ভালো স্কোর করেছে, যেখানে প্রতি পরিবারে গড়ে চার বা পাচ জন সদস্য রয়েছে। তবে যখন একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত বা তার বেশি হয়, যেমন ইনডিয়া ও বাংলাদেশে, তখন সেটি সুখের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হলো সামাজিক বিশ্বাস। এটি বোঝার জন্য মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয়, যদি তারা রাস্তায় মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলে, সেটি তারা ফেরত পাওয়ার কতটা আশা করে? বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ এই ব্যাপারে খুব আশাবাদী না হলেও বিশ্ববিদ্যালয় যখন আসলেই রাস্তায় হারানো মানিব্যাগ রেখে পরীক্ষা চালায়, তখন দেখা যায় প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি মানিব্যাগ ফেরত এসেছে।
স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করাও একটি বড় সুখের উপাদান। আগে অন্যকে সাহায্য করা নিজেকে সাহায্য করার আগেই দুই পক্ষের জন্যই সুখ নিয়ে আসে। হয়তো এটাই ব্যাখ্যা করে কেন যুদ্ধাবস্থায় থেকেও ইসরেল সুখের তালিকায় শীর্ষ দশে এসেছে কারণ ইহুদিদের মধ্যে একে অপরকে সাহায্য করার অসাধারণ মানসিকতা রয়েছে।
বাংলাদেশের তরুণরা সবসময় ব্যক্তিগত জায়গার খোজে থাকে বিশেষ করে রাজধানীর ভিড়ের কারণে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে তরুণরা এখন আগের চেয়ে আরো একা হয়ে পড়েছে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে অনলাইনে বেশি সময় দিচ্ছে, একা ঘরে থাকে, পড়াশোনার সময়ে সামাজিক কার্যকলাপে অংশ নেয় না, সম্ভবত কোভিডের প্রভাবে। এই কারণেই সাউথ কোরিয়ার মতো দেশে, ব্যবসায়িক সফলতা থাকলেও, সুখের পরিমাণ কমে গেছে।
কিন্তু আসল প্রশ্ন – বাংলাদেশ এই তালিকায় কোথায়? দুঃখজনকভাবে, বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১৩৪তম। ইনডিয়ার ঠিক নিচে। আসলে গত ১৫ বছরের পরিসংখ্যান দেখালে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই ইনডিয়ার চেয়ে বেশি সুখী ছিল, যদিও গত তিন বছরে সেই মাত্রা ব্যাপকভাবে কমেছে হয়তো এটাই শেখ হাসিনার বিদায়ের একটি কারণ হতে পারে।
যেসব দেশ আমাদের চেয়ে বেশি সুখী, তাদের মধ্যে আছে ইউক্রেন যেখানে তিন বছরের যুদ্ধ চলছে; মিয়ানমার- যারা সামরিক শাসনের অধীন আছে এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনকভাবে পাকিস্তান, যাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির এবং বাংলাদেশের চেয়ে জিডিপি কম হলেও তারা ১০৯তম স্থানে আছে। আফগানিস্তানের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, না হলে তারা হয়তো আমাদেরও পেছনে ফেলত।
তাহলে কীভাবে একটি দেশকে আরো সুখী করা যায়? সম্পদ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটা কেবল কিছু ধনকুবেরের জন্য নয় আমাদের দরকার সাধারণ মানুষকে কাজের সুযোগ দেয়া এবং তাদের সম্মানবোধ জাগিয়ে তোলা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা সরকারের ওপর এবং সমাজের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ায়।
এই পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ, তবে মনে রাখতে হবে সব যাত্রা শুরু হয় ছোট ছোট পদক্ষেপে।