যাযাদি ডেস্ক
বর ও কনে উভয়ই যদি থ্যালাসেমিয়া জিনের বাহক হন, তবে তাদের সন্তানেরও থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। দিন দিন এ রোগের বৃদ্ধি রোধে বাহকের সঙ্গে বাহকের বিয়ে বন্ধের বিকল্প নেই। বিয়ের আগে তাই রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব আসছে।
প্রয়োজনে জাতীয় পরিচয়পত্রে রক্তের গ্রুপের মতো থ্যালাসেমিয়া স্ট্যাটাস উল্লেখ করা, বিশেষ করে বিয়ের রেজিস্ট্রতে থ্যালাসেমিয়া স্ট্যাটাস নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করাও এখন সময়ের দাবি। অর্থাৎ বাহক-বাহক বিয়ে বন্ধ করার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন থ্যালাসেমিয়া সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও সেবকরা।
বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যাশা নিয়ে আজ ৮ মে, বৃহস্পতিবার, পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতি বছর নানা সচেতনতার বাণী নিয়ে পালিত হয় দিবসটি। বিভিন্ন কারণে দিবসটি তাৎপর্যপূর্ণ। এটি জনসাধারণকে থ্যালাসেমিয়া এর লক্ষণ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করে। আক্রান্ত ব্যক্তি এবং পরিবারগুলোকে সচেতন করা হয়। জনশিক্ষা, রোগ নির্ণয়সহ এর সমাধান নীতিতেও মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। এ বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ি। রোগীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করি’। সাধারণত রক্ত স্বল্পতার জন্য একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রতি মাসে এক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত শরীরে নিতে হয়। ঘন ঘন রক্ত নেয়া ও পরিপাক নালি থেকে আয়রনের শোষণ ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে লিভার, হৃৎপিণ্ডসহ নানা অঙ্গ ও গ্রন্থিতে নানা জটিলতা দেখা দেয়। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত রক্ত না নিলে থ্যালাসেমিয়া রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। রক্ত গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও সুচিকিৎসা প্রয়োজন। নিয়মিত রক্ত দিয়ে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সঠিকভাবে চিকিৎসা করালে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বাচিয়ে রাখা সম্ভব।
থ্যালাসেমিয়া রোগের একমাত্র কার্যকরী চিকিৎসা বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। নানা কারণে সবার পক্ষে এই চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয় না। তাই প্রতি মাসেই রক্তের ওপর নির্ভর করে চলতে হয় আক্রান্ত রোগীকে। অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের
সারা জীবনই অন্যের রক্ত নিয়ে বেচে থাকতে হয়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন রক্তদান কার্যক্রমের সংগঠনগুলোর রক্তের একটা বড় অংশ সরবরাহ হয় থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য। দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের অন্যতম সংগঠন কোয়ান্টাম ল্যাবের এক হিসাব অনুযায়ী, কোয়ান্টাম থেকে বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৩৩১ ইউনিট রক্ত থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০০০ সালে কোয়ান্টাম ল্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত সরবরাহকৃত প্রায় ১৭ লাখ ইউনিট রক্ত ও রক্ত উপাদানের চার ভাগ অর্থাৎ ৪ লাখ ইউনিট রক্ত বা রক্ত উপাদান সরবরাহ হয়েছে শুধু থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য। আর সারা দেশে সংঘবদ্ধ রক্ত সেবা ছাড়াও এককভাবে রক্ত সংগ্রহ বা বিতরণের হিসাব তো অজানাই থেকে যাচ্ছে।
বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস ২০২৫ উপলক্ষে থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক সভায় উপস্থাপিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে বংশগত রক্তরোগ থ্যালাসেমিয়া রোগী দিন দিন বাড়ছে। গত সাত বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। প্রতিবছর ৬ থেকে ৭হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। আমাদের দেশে বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী রয়েছে। অর্থাৎ মোট জনগোষ্ঠীর ১১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক।
রোগ হলে চিকিৎসার চেয়ে আগেই রোগ প্রতিরোধে সর্বত্র সচেতনতা ছড়ানো প্রয়োজন। মানুষকে জানতে হবে থ্যালাসেমিয়ার বাহক মানেই রোগ নয়। তিনি কিন্তু সুস্থ। তবে দুজন বাহক বিয়ে করলে তাদের সন্তানের এ রোগের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। বাহকে বাহকে বিয়ে বন্ধ করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া রোগমুক্ত দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। বাহকদের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করে সাইপ্রাস, ইটালি ও গুসের মতো দেশ থ্যালাসেমিয়া রোগী প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে। বিয়ের আগে হবু স্বামী বা স্ত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না তা সবারই জেনে নেয়া দরকার। এজন্য বিয়ে নিবন্ধনের সময় থ্যালাসেমিয়া আছে কি না, বিষয়টি বাধ্যতামূলক দেখা যেতে পারে। থ্যালাসেমিয়া দিবসে স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি দেশব্যাপী এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।