যাযাদি রিপোর্ট
নানা অনিয়মের কারণে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে। কমিশনের নিজস্ব আইনে পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। মন্ত্রণালয় অহেতুক হস্তক্ষেপ করছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান না করা হলে পুরোপুরি কর্ম বিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কর্মরতরা।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই আগারগাঁও পরমাণু শক্তি কমিশন চত্বরে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা অবস্থান কর্মসুচী পালন করছিলেন। দুপুর ১২টায় পরমাণু ভবনের ড. আনোয়ার হোসেন অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের স্বায়ত্বশাসন পুণঃপ্রতিষ্ঠা এবং মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও কর্তৃত্ববাদী আচরনের প্রতিবাদে’ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই দাবি করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কর্মকর্তা-কর্মচারি সমিতির সভাপতি ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, কমিশনের সংবেদনশীল তথ্য ও বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইলের ফাঁসের পায়তারা চলছে। কমিশনের ৫২ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের তথ্য আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এসব ব্যাপারে সরকার আন্তরিক হলেও মন্ত্রণালয় অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে। এটি বন্ধ করতে হবে। কমিশনের আওতাধীন ৪০টি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে পরমাণু বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত গবেষণা, শিক্ষা ও সেবামূলক কর্মকান্ড আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে পরিচালিত হচ্ছে। ৮ লক্ষাধিক মানুষ ও শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন ধরণের সেবা দেওয়া হয়েছে। যেখানে একটি বেসরকারী হাসপাতালে ক্যান্সারের থেরাপি দিতে ৬৫ হাজার টাকা লাগে, সেখানে কমিশন মাত্র ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সেই সেবা দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
তিনি বলছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন চেয়ারম্যান ও ৪ জন সদস্যের সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পদগুলো শুন্য। এতে করে কমিশনের কাজ থেমে আছে। শুধু চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য আছেন। পুর্ণ কমিশন না থাকায় এবং মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করায় বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা-কর্মচারিরা চাকরির নিয়মানুযায়ী সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কমিশনের অনুকূলে অর্থ ছাড় না হওয়ায় বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশনপ্রাপ্তিসহ গবেষণা ও সেবা কার্যক্রম পরিচালনায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কমিশনে কর্মরত প্রায় ৬০০ বিজ্ঞানীসহ ২ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর চলতি বছরের মার্চ মাসের বেতন-ভাতাদি পাননি। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পেনশনভাতা ও আনুতোষিকসহ অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন না।
কমিশনের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর, কোবাল্ট ৬০ গামা ইরেডিয়েটর, সাইক্লোট্রন, ট্যান্ডেম অ্যাক্সিলারেটর ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ফ্যাসিলিটির মতো তেজস্ক্রিয় ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা আছে। স্পর্শকাতর এসব স্থাপনায় যেকোনো সময় নিউক্লিয়ার ও রেডিওলজিক্যাল ইমার্জেন্সির উদ্ভব হতে পারে। যা মোকাবেলায় কমিশনকে তাৎক্ষণিক প্রশাসনিক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। উপযুক্ত সময়ে এসব সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হবে।
তিনি আরও জানান, ২০১১ পর্যন্ত কর্মরত বিজ্ঞানীদের উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিদেশ গমনের সরকারি আদেশ (জিও) কমিশন থেকেই দেয়া হতো। ২০১১ সালে তৎকালীন সরকার কমিশনের জিও দেয়ার ক্ষমতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে দেয়। তখন থেকে কমিশনের বিজ্ঞানীদের উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের বাদ দিয়ে আমলারা নিজেরাই শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিদেশের বিভিন্ন বিশেষায়িত প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় কমিশনের নবীন বিজ্ঞানীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। অন্যথায় বড় ধরনের আন্দোলনসহ কর্মবিরতির কর্মসুচী ঘোষণা করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বাপশক) কর্মচারি কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. কামরুজ্জামান, বাপশক অফিসার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এটিএম গোলাম কিবরিয়া ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক ড. মো. গোলাম রসুলসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও অন্তত দুই হাজার কর্মকর্তা এবং কর্মচারি উপস্থিত ছিলেন।
একনজরে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অবদান ও চলমান কাজের কিছু অংশ নিম্নরুপঃ
—> রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যেখান থেকে দ্রুতই ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হবে l
—> ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অতি প্রয়োজনীয় PET CT স্ক্যান, স্বল্প খরচে কমিশনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে করা যায় l
—> বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের রেডিওএক্টিভিটি (তেজস্ক্রিয়তা) টেষ্টিং ফ্যাসিলিটিস, যা তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে; আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা ইহার অবদান জেনে থাকবেন।
—> নিউক্লিয়ার রিলেটেড যাবতীয় ডায়াগনস্টিক সার্ভিস যেমন বোন স্ক্যান, রেনোগ্রাম, থাইরয়েড স্ক্যান, আল্ট্রাসাউন্ড, বিএমডি ইত্যাদি। সেবাগুলো বিদ্যমান বিভিন্ন নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেন্টারে পাওয়া যায়।
—> পরমাণু চিকিৎসায় বোন স্ক্যান ও থাইরয়েড স্ক্যান সেবা প্রদানের জন্য রেডিওইসোটোপ (Tc-99, I-131) উৎপাদন করা হয় l
—> বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত উচ্চ প্রযুক্তির সকল LINAC ও Co-60 Teletherapy-মেশিনের স্ট্যান্ডার্ড ডোজ মাত্রা (QA) নিরূপনের মাধ্যমে ক্যান্সার রোগীর নির্ভুল চিকিৎসা প্রদান নিশ্চিত করা হয় l
—> শিল্প ক্ষেত্র, চিকিৎসা ক্ষেত্র সহ বিভিন্ন স্থাপনায় নিয়োজিত কর্মী ও সেবাপ্রাথী.জনগণের বিকিরণ সুরক্ষা প্রদান করা হয় l
—> বিকিরণ থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় টি.এল.ডি. (T.L.D.) সেবা, সারাদেশে এক্স-রে করে এরকম টেকনিশিয়ানরা এ বিষয়ে অবগত আছেন l
—> বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নমুনা বিশ্লেষণ সেবা প্রদান।
—> নন ডেস্ট্রাক্টিভ টেস্টিং (N.D.T.) এর মাধ্যমে বিমান, জাহাজ, সহ উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রাংশের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে ম্যাটেরিয়ালের গুণগত অবস্থা নিরূপণ সেবা প্রদান করা হয় l
—> পরিবেশ গত নমুনা (মাটি, পানি, খাদ্য দ্রব্য) এবং মানবদেহে আর্সিনিকের উপস্থিতি নিরূপন করা হয় l
—> বায়ু মন্ডলী ও পরিবেশে সে দূষন নিরুপনে সিসা সহ অন্যান্য ক্ষতিকর ধাতুর মাত্রা নির্ণয় সংক্রান্ত সেবা প্রদান করা হয় l
—> জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় পরিবেশে হেভি মেটাল (Ni, Cu, Cr, etc.) নির্ণয় সংক্রান্ত কাজ করা হয় l
—> সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে PET-CT– সেবা চলমান রাখার জন্য ফ্লোরিন-১৮ SDG উৎপাদন করে সরবরাহ করা হয় l
—> দেশব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতাল, ইন্ডাস্ট্রি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিত্যাক্ত হলে জন স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চায়নে তাদের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ ব্যবস্থাপনা সেবা প্রদান করা হয় l
—> উচ্চ প্রযুক্তির LINAC-মেশিন ব্যবহার করে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করা হয় l
—> Co-60 Gamma Irradiator ব্যবহার করে বিদেশে রপ্তানির জন্য খাদ্যদ্রব্য জীবাণু মুক্ত করা হয়, এছাড়া, সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির জীবাণু নাশ করা হয় l
—>আগুনে দেহের চামড়া পুড়ে গেলে বা দুর্ঘটনায় অঙ্গ হানি হলে পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবাণু মুক্ত অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয় l
—> পরিবেশ বান্ধব ও ১০০ বছর টেকসইযোগ্য জুটিন আবিষ্কার l
—> আগুনে পুড়ে নানৰ দেহে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হলে কিংবা দুর্ঘটনায় অঙ্গ হানি হলে পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত অঙ্গ প্রতিস্টাফোন করা হয় l
—> পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ, ফসলের নতুন প্রজাতি উদ্ভাবন, ফলের কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ সহ মশা/মাছি দমন করা হয় l
—> নিয়মিত পরমাণু প্রযুক্তি ভিত্তিক দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী গবেষণা কাজ করা হয়।
খুবই দুঃখজনক। এদেশে মেধাবীদের মূল্য দেয়া তো দুরের কথা, বুঝার মানুষেরই অভাব। মুক্ত বিজ্ঞান চর্চা ছাড়া দেশ এগোতে পারেনা।